আশিকুর রহমান সবুজ শ্রীপুর
গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরমী বাজার। শীতলক্ষ্যার পাড়ে গড়ে ওঠা এই প্রাচীন জনপদটি শুধু তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা বাণিজ্যিক ব্যস্ততার জন্যই পরিচিত নয়, এর এক বিশেষ আকর্ষণ হলো বংশ পরম্পরায় এখানে বসবাসকারী হাজারো বানর। যুগ যুগ ধরে বরমীর ইতিহাস, সংস্কৃতি আর প্রতিদিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই রীসাস মাকাক (Rhesus Macaque) প্রজাতির বানরেরা।
এক সময় বরমী বাজারে প্রবেশ করলেই দেখা যেত শত শত বানরের দল। বাজারের ছাদে, গাছের ডালে, দোকানের উপর— সর্বত্রই তাদের অবাধ বিচরণ। দর্শনার্থীদের দেওয়া খাবার বা ফেলে রাখা ফলমূল কুড়িয়ে খাওয়া, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করা, আর কৌতূহলী চোখে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। মা বানরের বুকে শাবকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়, অথবা দুষ্টু বানরের দলছুট হয়ে দৌড়ঝাঁপ— এসব দৃশ্য বরমী বাজারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। স্থানীয়রা তাদের বাজারের অংশ মনে করত, আর তাদের উপস্থিতি বাজারের ঐতিহ্যকে আরও জীবন্ত করে তুলত।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই ছবি আজ অনেকটাই ধূসর। নগরায়ন, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং মানুষের বসতি বৃদ্ধির কারণে এই বানরদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংকুচিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে খাদ্যসংকট। একসময় গ্রামের মানুষের উদারতা বা বাজারের উচ্ছিষ্ট তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখন সেই চিত্র বদলে গেছে। খাদ্যের অভাবে ক্ষুধার্ত বানরেরা প্রায়শই লোকালয়ে প্রবেশ করে, মানুষের বাড়িতে বা দোকানে হানা দেয়। তাদের এই আচরণকে অনেক সময় উপদ্রব হিসেবে দেখা হলেও, এর মূলে রয়েছে তাদের বেঁচে থাকার এক কঠিন সংগ্রাম।
সংখ্যাও কমে আসছে উল্লেখযোগ্য হারে। যে হাজার হাজার বানর ছিল একসময় বরমী বাজারের অহংকার, আজ তাদের সংখ্যা নেমে এসেছে এক চতুর্থাংশে। এটি কেবল বন্যপ্রাণীর সংখ্যা হ্রাস নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্যের বিলুপ্তি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে বানরদের সাথে সহাবস্থান করে এসেছেন, সেই সহাবস্থানের ধারা আজ হুমকির মুখে।
বরমীর বানর কেবল প্রাণী নয়, তারা এই অঞ্চলের একটি প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কেবল পরিবেশগত দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্বও বটে। স্থানীয় জনগণ এবং পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে এদের জন্য সরকারিভাবে স্থায়ী খাদ্য সরবরাহের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
একটি সমৃদ্ধ জনপদের পরিচয় কেবল তার ইট-কাঠের দালানে নয়, তার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সেখানে বসবাসকারী প্রাণীদের সাথে তার সহাবস্থানেও। বরমী বাজারের বানরেরা আজও সেই সহাবস্থানের নীরব সাক্ষী। তাদের এই নীরব কান্না আমাদের শুনতে হবে। এখনই সময় এদের সুরক্ষায় সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার, যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্মও বরমী বাজারের এই ঐতিহ্যবাহী বানরদের দেখতে পায়, এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের গল্প শুনতে পায়।