মনজুর রহমান শান্ত
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী,শিক্ষার্থীদের সামর্থ্যের কথা একটু ভাবুন ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠ নামক বইটির ১৭ পৃষ্ঠায় পদার্থের ঘনত্ব সম্পর্কে লেখা হয়েছে। যদিও স্পষ্টভাবে ঘনত্বের সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি, তবে ঘনত্ব নির্ণয়ের সুত্র প্রদান করা হয়েছে:
ঘণত্ব ρ=m/v
এখানে ইংরেজি অক্ষর P এর মত যে বর্ণটি দিয়ে ঘণত্ব প্রকাশ করা হয়েছে সেটা প্রকৃতপক্ষে গ্রীক অক্ষর, রো (ρ)।
এখানে ঘনত্বের একক লেখা হয়েছে গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার বা gm/cc
সব কিছুই ঠিক আছে। ঘনত্বের একক কেজি/ঘনমিটার বা kg/m3 আর ছোট এককে গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার।
এখন আমি দেশের জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত ব্যক্তি, শিক্ষা বিভাগের সুশিক্ষিত কর্মকর্তা, যারা এই পাঠক্রম তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদেরকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে চাই যে, ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা কি ঘনত্ব কি জিনিস, তা বোঝে? যারা সবেমাত্র প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের সর্বনিম্ন শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে, ρ=m/v সুত্রটি কি তাদের মাথায় ঢোকানো সম্ভব? তারা কি বুঝতে পারবে যে, m ভরের একটা বস্তুর আয়তন v হলে, ঘনত্ব ρ=m/v
এখানে বস্তুর ভরকে m দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে, যা mass নামক ইংরেজি শব্দ থেকে এসেছে। এই শব্দটিই তো ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে দুর্বোধ্য। তাহলে তারা ρ=m/v সুত্রের সাহায্যে ঘনত্ব নির্ণয় করার পদ্ধতি কিভাবে আত্মস্থ করবে। তার উপর উপরোক্ত সুত্রের মাধ্যমে ঘনত্ব নির্ণয়ের অংক দেওয়া হয়েছে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আপনি নিজেও জানেন এবং তারপরেও আপনার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, বর্তমানে প্রচলিত নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই পদার্থ বিজ্ঞানের পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম হলো “পদার্থের অবস্থা ও চাপ।” এই অধ্যায়ের মধ্যে ঘনত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, বস্তুর একক আয়তনের ভরকে ঘনত্ব বলে। যদি m ভরের বস্তুর আয়তন v হয় তাহলে,
ঘনত্ব ρ=m/v হবে। এখানে ভরের আন্তর্জাতিক একক কেজি (kg), আয়তনের একক ঘনমিটার (m3) হওয়ায় ঘনত্বের একক কেজি/ঘনমিটার (kg/m3), ষষ্ঠ শ্রেণির বইতে কেজিকে গ্রাম এবং মিটারকে সেন্টিমিটারে প্রকাশ করা হয়েছে।নবম-দশম শ্রেণির পদার্থ বিজ্ঞান বইয়ের এই অধ্যায়ে ঘনত্ব সম্পর্কে বেশ কিছু গানিতিক সমস্যা দেওয়া হয়েছে, যা প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষার পরীক্ষার্থীদের ভাবিয়ে তোলে। অথচ একই ধরনের গানিতিক সমস্যা ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বইতেও দেওয়া হয়েছে। বইয়ের ১৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ঘনত্বের বর্ণনার নীচে লেখা হয়েছে যদি একটি আম গাছের গুড়ির আয়তন ২৫০০ ঘনসেন্টিমিটার হয় এবং সেই গুড়ির ভর যদি ১৫০০ গ্রাম হয়, তাহলে তার ঘনত্ব হবে ১৫০০ গ্রাম/২৫০০ ঘনসেন্টিমিটার = ০.৬ গ্রাম/ঘনসেন্টিমিটার।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, গণমাধ্যমের পাতায় দেখলাম, আপনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বলেছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের যাতে হুবহু মুখস্ত করতে না হয়, তার জন্য এই নতুন পাঠক্রম চালু করা হয়েছে। আমি স্বীকার করছি আপনার উদ্দেশ্য মহত্তর, কিন্তু প্রেক্ষাপট হয়ে গেছে ভিন্ন। যারা আপনার বিষয়টি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে উপস্হাপনের দায়িত্বে আছে, তারা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনি একটিবারের জন্য ভেবে দেখুন, উপরোক্ত বিষয়টি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে বোঝা সম্ভব কি? ρ=m/v এই সুত্রটিতে, যেখানে দশম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা হিমসিম খায়, সেই সুত্র ষষ্ঠ শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সরাসরি মুখস্ত করা ছাড়া বুঝে কাজ করতে পারবে- এই ধারণা কি আদৌ সম্ভব?
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আমি আপনার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সবিনয় অনুরোধ করছি, ঢাকা শহরের ছাত্র-ছাত্রীদের বাদ দিয়ে বিশ্বস্ত এবং বিচক্ষণ লোক দিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের উপর একটা জরিপের মাধ্যমে যাচাই করে দেখুন, আমার কথাগুলোর মধ্যে বিন্দুমাত্র সত্যের অপলাপ আছে কিনা। আমি ঢাকা শহরের ছাত্র-ছাত্রীদের বাদ দেওয়ার কথা বলেছি এই কারণে যে, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বিদ্যালয়গুলো যথেষ্ট নামকরা এবং এখানে আছে সুশিক্ষিত ও শিক্ষকতায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষক। এখানে শিক্ষাদান পদ্ধতি উন্নতমানের হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ঢাকা শহরের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকগণ যথেষ্ট সচেতন। তাদের সচেতনতার কারণে তাদের সন্তানরা শিশুকাল থেকেই অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে বাড়িতেই অনেক কিছু শিখে ফেলে। অভিভাবকগণ তাদের পেছনে একটা মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করেন, যা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের পেছনে ব্যয় করা হয় না, কারণ তাদের অভিভাবকদের সেই ধরনের সামর্থ্য নেই। তারা সন্তানদের দুবেলা দুমুঠো খাবার দিতেই হিমসিম খায়।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আমি আপনার সমীপে ঘনত্ব সম্পর্কিত আরও একটা ভয়ংকর তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি ঘটনাটি আপনাকে আরেকবার ভাবতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
সিটি করপোরেশন আছে এমন একটি মফস্বল শহরের ঘটনা। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত একটি বিদ্যালয়, যেটি শহরের মধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। সেই বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন পাঠের ক্লাস নেন একজন শিক্ষিকা, যিনি মানবিক বিভাগ থেকে ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাসে ঘনত্ব সহ সকল পাঠ্যগুলো প্রতিনিয়ত রিডিং পড়ান এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ঘনত্বের গানিতিক সমস্যা বাসা থেকে করে আনতে বলেছেন। কিভাবে এই গানিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয় ছাত্র-ছাত্রীরা কিছুই জানে না। তাই তারা কয়েকজন মিলে ম্যাডামকে করে দিতে বলেছিল। ম্যাডাম রেগে গেলেন এবং বললেন এগুলো তোমাদের করতে হবে, এসব ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ। তাছাড়া বইতে তো লেখা আছে নিজে কর। তাহলে তোমাদের করে দেব কেন?
শেষ পর্যন্ত তিনি উক্ত গানিতিক সমস্যাটি ছাত্র-ছাত্রীদের করে দেননি। তিনি মানবিক বিভাগের ডিগ্রীধারী হওয়ায় এসব সুত্রের গানিতিক সমস্যা তার কাছে পরিচিত নাও হতে পারে। কারণ একটা বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, মানবিক এবং ব্যবসায়ী শাখার শিক্ষক থাকেন। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকগণ নবম-দশম শ্রেণির পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এবং উচ্চতর গণিতের ক্লাস নিতেই ব্যস্ত থাকেন। যার ফলে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকদের নীচের শ্রেণির বিজ্ঞান ক্লাস নিতে হয়।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, উপরের এই ঘটনাটি কেবলমাত্র একটি বিদ্যালয়ের ঘটনা নয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক বিদ্যালয়ে এই ধরনের দৃশ্য প্রতিনিয়ত ঘটছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সেটা হলো ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির বইগুলো এমনভাবে করা যার সাথে লেখাপড়ার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সারা বই জুড়ে বিভিন্ন মডেল তৈরির অনুশীলনের প্রতি ছাত্র-শিক্ষক সকলেই অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে। আর অনাগ্রহী হওয়ার একমাত্র কারণ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে কোনো পরীক্ষা হবে না।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আমাদের পেটে ক্ষুধা না থাকলে আমরা খাবার গ্রহণ করি না, যদি আমাদের খাবারের প্রয়োজন না হতো, তাহলে আমরা কাজকর্ম করতাম না। আর যদি আমাদের কাজকর্ম করতে না হতো, চাকরি করতে না হতো, তাহলে আমরা লেখাপড়াও করতাম না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, একটার প্রয়োজনে আমরা আরেকটা কাজ করে থাকি। ঠিক তেমনি, যারা লেখাপড়া করে, তাদের বছর শেষে পরীক্ষায় পাশ করতে হয় বলে তারা নিয়মিত লেখাপড়া করে। ভালো রেজাল্ট করার নিমিত্তে প্রতিদিন লেখাপড়ায় নিমগ্ন থাকে। যদি ভাল রেজাল্ট করার টেন্ডেন্সি না থাকতো, যদি পরীক্ষায় পাশ করার প্রয়োজনীয়তা না থাকতো, তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ায় মনোযোগ দিত না। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ষষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে কোন পরীক্ষা নাই। তাই এখন লেখাপড়ার সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নাই।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, একমাত্র আপনি পারেন তাদের লেখাপড়ায় মনোযোগী করতে, তাদের পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে তাদেরকে আবার লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনুন। তাদের নিশ্চিত উচ্ছন্নে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করুন। পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হলে তারা আবার লেখাপড়ায় নিমগ্ন হবে।
তাই, আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি যে, কেবলমাত্র ঢাকা শহরের পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিচার করবেন না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশ্বস্ত লোক দিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখুন, নতুন বই নিয়ে কি হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় আবারো আপনার নজরে এনে আজকের লেখাটা শেষ করব। সেটা হলো, নতুন অংক বই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আমি প্রথম পর্বের লেখায় আপনাকে বিনীতভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলাম, আপনার শত ব্যস্ততার মাঝেও মাত্র ৩০ মিনিট সময় নিয়ে গণিত বইটি পর্যবেক্ষণ করুন, আপনার চোখের সামনে এর বিষয়বস্তু উন্মোচিত হবে। আপনি বুঝতে পারবেন, এখানে খেলার ছলে যে অংক দেওয়া হয়েছে, তা সময়ের অপচয় মাত্র। এর চেয়ে অনেক জটিল অংক অনেক আগেই ছাত্র-ছাত্রীরা শিখেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো অংক বইতে অনুশীলনমূলক কোনো অংক নেই। তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে গণিত শিখবে? তাই আপনার কাছে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি, ছাত্র-ছাত্রীদের গণিত শেখার সুবিধার্থে বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠের মত ষষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির গণিত বইটিও প্রত্যাহার করে নিন এবং অবিলম্বে পূর্বে প্রচলিত গণিত বইটি চালু করার আদেশ দিন। সারা দেশের ছাত্র-ছাত্রী, তথা অভিভাবক মহল আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
মনজুর রহমান শান্ত