সোহেল মিয়া,দোয়ারাবাজার(সুনামগঞ্জ):
ভাষা আন্দোলনের পর ৭১ বছর পার হলেও সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শহিদ মিনার নেই। শহিদ মিনার না থাকায় উপজেলার অনেক শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা নেওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি বরাদ্দ না থাকা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেওয়ার কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শহিদ মিনার গড়ে উঠছে না। এ কারণে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারছেন না এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। ভাষা সৈনিকদের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও প্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
তবে শহিদ মিনার না থাকলেও কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে স্থানীয় উপকরণ যেমন কলাগাছ, বাঁশ, কাঠ, কাগজ ও ককশিট দিয়ে অস্থায়ী শহিদ মিনার বানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
আবার অনেক শহিদ মিনারের জরাজীর্ণ অবস্থা। কিছু কিছু শহিদ মিনার অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। অনুসন্ধানে জানাগেছে- মহান একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে উপজেলার ৩৬ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করেছেন শিক্ষার্থীরা। শহিদ মিনার নেই তবে তাদের শহিদদের প্রতি ভালোবাসা আছে। তাই বাঁশ আর কাঠের শহিদ মিনারেই শ্রদ্ধা জানান তারা।
উপজেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নে ১০৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৪ টি মাধ্যমিক,১০ টি মাদ্রাসা, ৬ টি স্কুল এন্ড কলেজ ও ১টি ডিগ্রি কলেজ রয়েছে।
উপজেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজে শহিদ মিনার নেই,উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত ১০ টি মাদ্রাসা দোহালিয়া ইউপির মঙ্গলপুর দারুল হেরা জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা,বোগলাবাজার ইউপির পেশকারগাঁও দাখিল মাদ্রাসা,দোয়ারা সদর ইউপির লামাসানিয়া জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা,বাংলাবাজার ইউপির কলাউড়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, ইসলামপুর( আছিরনগর)দাখিল মাদ্রাসা ও বড়ইউড়ি দারুসুন্নাহ বহুমুখী আলিম মাদ্রাসা,লক্ষিপুর ইউপির চামতলা দাখিল মাদ্রাসা, দোয়ারা সদর ইউপির সিদ্দিকি আকবর দাখিল মাদ্রাসা,নরসিংপুর ইউপির দ্বীনেরটুক আলিম মাদ্রাসা ও নরসিংপুর দাখিল মাদ্রাসার এই ১০ টি মাদ্রাসার একটিতে ও নেই শহিদ মিনার।মোট ১০৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২১ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোন শহিদ মিনার নেই,মাত্র ৮৩ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থায়ী শহিদ মিনার আছে। এছাড়া উপজেলার দোহালিয়া ইউপির হাজি নুরুল্লাহ তালুকদার দশগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়,বাংলাবাজার ইউপির চৌধুরী পাড়া শহিদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয় ও সোনার বাংলা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়,নরসিংপুর ইউনিয়নের সোনালী চেলা উচ্চবিদ্যালয়ে ও এখনো স্থাপিত হয়নি শহিদ মিনার।
এনিয়ে স্থানীয় সচেতন মহল জানান ভাষা আন্দোলন ও শহিদদের আত্মত্যাগ কখনোই ভোলার নয়। শিশু, কিশোর ও তরুণদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের কথা সব সময় মনে করিয়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষার প্রথম ধাপ হলো বিদ্যালয়। তাই উপজেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে খুদে শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলন, মাতৃভাষা দিবস ও শহিদ মিনারের তাৎপর্য
সোনালী চেলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম সংবাদপত্রকে বলেন, তাঁর বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নেই। তবে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সংগ্রহ করে আনা বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে শহিদ মিনার তৈরি করেছে। আজ মঙ্গলবার সকালে সেখানে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়েছে।
কলাউড়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার সুপার মাও.কালিমউল্লাহ বলেন, কলাউড়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসাটি ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ শতাধিক। মাদ্রাসাটি পুরোনো হলেও সেখানে শহিদ মিনার নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে তাঁর প্রতিষ্ঠানে আজ সকালে প্রভাতফেরির সময় স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের অংশ পালন করেন। তবে দিবসটি উপলক্ষে ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আলোচনাসভা, রচনা প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ একরামুল হক বলেন, ‘আমরা একাধিক বার শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু আমাদের সাংসদ বারবার আশ্বস্ত করলেও, উপজেলা প্রশাসন বারবার আশ্বস্ত করলেও আমাদের শহিদ মিনার আজও নির্মাণ করা হয়নি।’ কোন প্রকার সহযোগিতা না পেয়ে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ আমরা কলেজের শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে শহিদ মিনার নির্মানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পঞ্চনন কুমার সানা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শহিদ মিনার স্থাপনে সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়েই মূলত শহিদ মিনার তৈরি করা হয়। উপজেলার যেসব বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার আছে, সেগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে সহায়তা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। যেসকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহিদ মিনার নেই আমি উনাদের উদ্ভুদ্ধ করছি শহিদ মিনার স্থাপনের ব্যবস্থা করার।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অশুক কুমার পুরকায়স্থ বলেন, উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা,স্কুল এন্ড কলেজ, কলেজ নিয়ে ৩১ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। তবে কিছু কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার স্থাপন করা যায়নি। মূলত সরকারি বরাদ্দ না থাকায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার স্থাপন করা যাচ্ছে না। স্থানীয় লোকজনের সহায়তা ও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলোতে শহিদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করতে হবে।